— কি সেলাই করেন!
শীতের রাত, প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে, জেলা সদরের নির্জন ফুটপাতে উদোম শরীরে বসা এক লোক, একপাশে মুচিদের ব্যবহার করার মত বাক্স, নিয়নের আলোয় স্যান্ডেল সদৃশ কিছু সেলাই করছিলেন। প্রশ্ন শুনে মাথা না তুলেই উত্তর দিলেন,
— নসীব।
এমন উত্তর আশা করিনি। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম,
— কার নসিব!
এবার লোকটি মুখ তুলে তাকালেন। চেহারায় বয়সের ছাপ, পরিচর্যাহীন শাদা দাড়িগোঁফ, ভাঁজপূর্ণ ত্বক, কিন্তু নিয়নের আলোতেও তার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। একটু হেসে বললেন,
— কার নসিব সেলাই করি? আপনা নাসিব.. বাবা, আপনা নাসিব..
খেয়াল করলাম, তার উচ্চারিত ‘নসিব’ হঠাৎ করেই ‘নাসিব’ হয়ে গেছে। এসব ছোটো ছোটো পরিবর্তন সবসময়ই কৌতূহলী করে তোলে। তাকে বললাম,
— আপনার পাশে বসে একটু নাসিব সেলানো দেখি?
তিনি মাথা নিচু রেখেই উত্তর দিলেন,
— আপনার ইচ্ছা। আমার নাসিব সেলানো দেইখা কার কি লাভ!
তার পাশে বসলাম৷ প্রায় দশ মিনিট একটা স্যান্ডেলের সোল তিনি সুতো ছাড়া সেলাই করে গেলেন। সেলাই শেষ করে বক্সের ভিতর সোলটা রেখে আরেকটা সোল বের করে সেলাই শুরু করলেন। স্বভাব দোষে প্রশ্ন করলাম,
— এটা কার নাসিব!
— এটা নাসিব না রে বাবা, এটা জিন্দেগী
— কার জিন্দেগী?
— আপনা জিন্দেগী।
পাঁচ মিনিট জিন্দেগী সেলাই করে বক্সে রাখতে বললাম,
— আসেন, শীতের রাতে গরম গরম ভাত খাই।
— তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
বড় হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাস আর লঞ্চ টারমিনাল সংলগ্ন কিছু হোটেল সারারাত খোলা থাকে। এমন এক হোটেলের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম, তিনিও বসলেন। শীতে কাঁপছি, তিনি নির্বিকার। উনার খাওয়ার অর্ডার দিলাম, আমি ঘরে ফিরে খাবো। খাওয়া শেষে তাকে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা সাধলাম, তিনি নিলেন না। ঠোঁটে শিশুর মত হাসি, বললেন,
— আলহামদুলিল্লাহ! টাকা দিয়া কি করবো! টাকা দিয়া নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করা যায় না বাবা..
আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন, বয়সের তুলনায় দ্রুতই হাঁটছেন। অথবা যারা রাতে নির্জন পথে নিজের নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করেন তারা হয়তো দ্রুতই হাঁটেন।
.
স্মৃতি লিখে রাখি| ২৫ডিসেম্বর (২৪ডিসেম্বর দিবাগত রাত)
loading...
loading...
অবাক বিষ্ময়ে অণুগল্পটি পড়ে গেলাম। নিঃসন্দেহে ভালো লিখেছেন।
loading...
লেখাটি অনেক ভালো লাগছে। আমার ও অজানা পথে একাকী হাটতে, স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে মিশতে ভালো লাগে।
loading...